সামনে আসছে পহেলা বৈশাখ। সন্দেহ নেই, প্রতিবছরের মতো এবারেও লাল-সাদা শাড়ি পড়ে, নেচে-গেয়ে, বাদ্য বাজিয়ে, মুখে উল্কি এঁকে, মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে যাবতীয় অমঙ্গলকে দূর করে আর সর্বোপরি ইলিশ-পান্তা খেয়ে এদেশের নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত জনগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ পালন করবে। রমনা বটমূলে অনুষ্ঠিত হবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মনমাতানো অনুষ্ঠান, ঢাকার পথে পথে বসবে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, ঢাকার রাজপথে চারুকলা ইন্সটিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বৈশাখের ভ্যাঁপসা গরমকে উপেক্ষা করে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সমাগম হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের, আত্মপরিচয় বিস্মৃত মুসলিম জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে ছেলে-বুড়ো সকলেই সম্মোহিত মানুষের মতো ছুটবে বৈশাখী উৎসবে যোগ দিতে, মেতে উঠবে উৎসবের আমেজে।
বস্তুত: বাংলা নববর্ষ পালন এবং এদিনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত উৎসব, আয়োজন ও অনুষ্ঠান এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলাই যেন এ সমাজে চুড়ান্ত মাত্রার এক পশ্চাদপদতা। এ দেশের সভ্যভব্য, প্রগতিশীল আর সংস্কৃতিমনা মানুষেরা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে কোন প্রশ্ন ছাড়া পহেলা বৈশাখ পালন করবে এটাই এখন স্বাভাবিক। এছাড়া, এদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের দাবী অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ নাকি এদেশের ৯০ ভাগ মানুষের উৎসব ঈদকেও ছাড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হল, ঈদ মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব, যা সাম্প্রদায়িক। আর, পহেলা বৈশাখ হল এদেশের সকল মানুষের প্রাণের উৎসব, যা কিনা অসাম্প্রদায়িক। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সুশীলবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের পক্ষে সাফাই গাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এদেশের নব্বই ভাগ মুসলিম যারা এখনও এক আল্লাহ’র অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন এবং নিজেদের মুসলিম বলে দাবীও করেন, তাদের বলবো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সুশীল সমাজ এবং এদেশের পুঁজিবাদী মিডিয়া, যারা পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বাণিজ্য করেন, তাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে অন্ধ ভাবে পহেলা বৈশাখ পালন না করে, এ উৎসব সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে।
• প্রথমত: সুশীল সমাজের দাবী অনুযায়ী পহেলা বৈশাখের উৎসব কি অসাম্প্রদায়িক:
ভারতবর্ষে মুঘল শাসনামলে সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করতো। কিন্তু, হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষির ফলনের সাথে মিলত না। এজন্য সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্তে সৌর ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল “ফসলি সন”। এভাবেই, বাংলাসন গণণা আরম্ভ হয়। তবে, বর্তমানে যে রকম ঢাকঢোল পিটিয়ে, বাদ্যবাজনা বাজিয়ে বা শোভাযাত্রা করে বৈশাখের প্রথম দিনকে আমন্ত্রন জানানো হয়, পেছনে ফিরে তাকালে আমরা এসব কোনকিছুই দেখতে পাবো না। বস্তুত: আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। যে বছর প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ আর পূজার ব্যবস্থা করা হয়। আর, পহেলা বৈশাখকে সমস্ত বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব বা হিন্দু-মুসলিমের সার্বজনীন উৎসব বলে চালানোর ব্যাপক প্রচারণা চালানো হলেও, এ উৎসব কখনই এ অঞ্চলে সার্বজনীন কোন উৎসব ছিল না। বস্তুত: আমাদের দেশে মাত্র কয়েক দশক যাবত ঘটা করে নববর্ষ উৎযাপন করা হচ্ছে। অতীতে পহেলা বৈশাখে প্রধান কাজ ছিল সারা বছরের দেনা-পাওনার হিসাব নিকাশ, খাজনা আদায়, শুল্ক পরিশোধ করা ইত্যাদি। এদিনে হিন্দু জমিদাররা নিজ নিজ প্রজাদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ণ করতো এবং এ অনুষ্ঠানকে বলা হতো “পূণ্যাহ”। খাজনা আদায়ের পুরনো হিসাব-নিকাশের পাট চুকিয়ে বৈশাখের প্রথম দিন থেকে নতুন খাতা খোলা হত, যাকে বলা হত “হালখাতা”। পুরনো ঢাকার হিন্দু স্বর্ণকারদের মধ্যে হালখাতা অনুষ্ঠানের বেশী প্রচলন ছিল।
এছাড়া, পহেলা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ, চৈত্রের শেষ দিনে, বাঙ্গালী হিন্দুরা চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব পালন করতো। এটি তাদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এদিন তারা ঘরদুয়ার ধুয়েমুছে পরিস্কার করে সারা বছরের আবর্জনা দূর করতো। এখনও পুরনো ঢাকার হিন্দুরা এদিন ঝাড়ু হাতে ওঝা সেজে ভূতপ্রেত, অমঙ্গল বা অনিষ্টকে দূর করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এ উৎসবকে কেন্দ্র করেই পহেলা বৈশাখে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হতো, যা এখনও হয়। এছাড়া, পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারণাও পুরোপুরি মূর্তিপূজারীদের কুসংস্কারাচ্ছ বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। কারণ, এ শোভাযাত্রায় অশুভ বা অমঙ্গল সাধনকারী শক্তি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর বাহনের মূর্তি যেমন: কার্তিকের বাহন ময়ূর, স্বরস্বতীর বাহন হাঁস, লক্ষীর বাহন পেঁচা ইত্যাদি সহ বিভিন্ন রাক্ষস-খোক্ষস ও জীবজন্তুর বিশাল মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়।
এছাড়া, দিনের প্রথম প্রত্যুষে নতুন সূর্যকে যেভাবে সুরের মূর্ছনায় বরণ করে নেয়া হয়, সেটাও হাজার বছরে পূর্বের সূর্যপূজারী বা প্রকৃতিপূজারী সম্প্রদায়ের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়, যা আধুনিকতা ও সূর্যবন্দনার নামে শয়তান মানুষের কাছে শোভনীয় করেছে। বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন সূর্যের কাছে প্রকৃতিপূজারীদের মতোই নিজেদের অমঙ্গল থেকে রক্ষার জন্য সূর্যের নিকট প্রার্থনা করা হয়। সুতরাং, এটা সুস্পষ্ট যে, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা সূর্যবন্দনা এ প্রতিটি অনুষ্ঠানিকতা পুরোপুরি মুর্তিপূজারীদের বিশ্বাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সুতরাং, এ অনুষ্ঠান কোনভাবেই অসাম্প্রদায়িক নয়, বরং সর্বাংশে সাম্প্রদায়িক। তাহলে, প্রশ্ন আসে, নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এদেশে হিন্দু সম্প্রদায় বা মুশরিক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস বা আচার আচরণের সাথে সরাসরি সর্ম্পকিত উৎসব কিভাবে এদেশের মানুষের প্রাণের উৎসব হতে পারে?
• নিজেকে মুসলিম দাবী করার পর আমরা কি পহেলা বৈশাখ পালন করতে পারি ?:
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা একটা শ্লোগান খুব বেশী শুনতে পাই, আর তা হল: “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। অর্থাৎ, আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যে সম্প্রদায়ের অংশ হই না কেন, উৎসব পালন কালে আমরা সবাই এক। আমাদের বুঝতে হবে যে, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”- এ শ্লোগানটি এই পুঁজিবাদী সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে (সেুক্যুলারিজম) বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর শ্লোগান, যারা বিশ্বাস করে যে, ধর্ম শুধুমাত্র কিছু রীতিনীতি কিংবা আচার অনুষ্ঠানের সমষ্ঠি এবং মসজিদ কিংবা মন্দিরের মতো উপাসনালয় ছাড়া আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, শাসনব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতি কোনকিছুতেই ধর্মের কোন স্থান নেই। কিন্তু, ইসলামের মূলনীতি বা বিশ্বাসের সাথে এ বিশ্বাস বা শ্লোগান পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
ইসলাম কোন ধর্ম নয়, এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম: হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম কিংবা খ্রিষ্টান ধর্মের মতো ইসলাম শুধুমাত্র কিছু আচার-আচরণ সবর্স্ব ধর্ম নয়। আল্লাহতায়ালা ইসলামে একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা বা দ্বীন হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। সুরা মায়িদাহ’তে আল্লাহ বলেন:“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবনব্যবস্থা (দ্বীন) হিসাবে মনোনীত করলাম।” আর তাই, ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্র জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। সুতরাং, মুসলিমদের অন্য ধর্মের অনুসারীদের মতো ইসলামকে জীবন ও রাষ্ট্রের সকল স্থান থেকে বিতাড়িত করে শুধুমাত্র উপাসনালয়ে বন্দী করে রাখার কোন সুযোগ নেই।
ইসলামী জীবনব্যবস্থার রয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি: মুসলিমদের জন্য ভিন্ন কোন সম্প্রদায় যেমন: ইহুদী, নাসারা, মুশরিক কিংবা অগ্নিপুজারীদের সংস্কৃতি বা আচার-আচরণ অনুকরণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুল (সা) বলেছেন: “কেউ যদি কোন সম্প্রদায়কে অনুকরণ করে, তবে তাকে (শেষবিচারের দিনে) তাদের একজন বলে গণ্য করা হবে।” সুতরাং, মুসলিমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও আমরা যদি মূর্তিপূজারীদের সংস্কৃতিকে অনুকরণ করি তবে, শেষ বিচারের দিনে আমাদের তাদের একজন হিসাবে গণ্য করা হবে। এছাড়া, হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে,“যখন আল্লাহ’র রাসুল মদীনায় আসলেন, তখন মদীনার অধিবাসীদের দুটো উৎসবের দিন ছিল, যে দিনগুলোতে তারা আনন্দ-উৎসব করতো। তিনি (সা) সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন, “এ দিনগুলো কিসের জন্য?” তারা বললো: “জাহেলিয়াতের যুগে আমরা এ দিনগুলোতে আনন্দ-উৎসব করতাম।” আল্লাহ’র রাসুল (সা) বললেন, “আল্লাহতায়ালা তাদের এদুটো দিনের চাইতে উত্তম দুটো দিন তোমাদের দান করেছেন। আর তা হল: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা’র দিন।” (আবুদাউদ, হাদিস নং, ১১৩৪) এছাড়া, অন্য একটি হাদিসে রাসুল (সা) বলেছেন:“…প্রতিটি সম্প্রদায়েরই নিজস্ব উৎসব রয়েছে এবং এটি (ঈদের দিন) হল আমাদের উৎসব।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং, ৯৫২) সুতরাং, এ হাদিসগুলো থেকে এটা প্রমাণিত যে, মুসলিমদের জন্য যে কোন উৎসবকে সার্বজনীন ঘোষণা দিয়ে, তা ঢালাও ভাবে পালন করার কোন সুযোগ নেই।
আসলে একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো যে, এ পৃথিবীর বেশীর ভাগ উৎসবের সাথেই কোন না কোন ধর্মীয় বিশ্বাস উতপ্রোত জড়িত রয়েছে। যেমন: ইষ্টার কিংবা বড়দিনের সাথে খৃষ্টধর্মীয় বিশ্বাস জড়িত। আবার, দূর্গাপূজা বা দিওয়ালী উৎসবের সাথে হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস জড়িত। হানুক্কাহ কিংবা সাববাথ ইহুদী ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে জড়িত। পুঁজিবাদী বিশ্ব মুনাফা হাসিলের লক্ষ্যে, ভ্যালেন্টাইন ডে, পশ্চিমা নববর্ষ, হ্যালোইন কিংবা পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবগুলোকে সার্বজনীন বলে বাজারজাত করতে চাইলেও, মূলত: এ সমস্ত উৎসবের মূলে ধর্মীয় বিশ্বাস যু্ক্ত রয়েছে। যেমন: “ভ্যালেন্টাইন ডে” উৎসবের মূলে রয়েছে মূর্তিপূজারী রোমান সম্প্রদায়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস। যে কারণে, খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাস অক্ষুণ্ন রাখতে পঞ্চম শতাব্দীতে ইউরোপের ক্যাথলিক চার্চ রোমান মূর্তিপূজারীদের উৎসব ভ্যালেন্টাইন’স ডে’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তারপর থেকে বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপে এ উৎসব নিষিদ্ধই ছিল। সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি পরিস্কার যে, মূর্তিপূজারীদের বিশ্বাস থেকে উত্থিত পহেলা বৈশাখ না মুসলিমদের সংস্কৃতির কোন অংশ, আর না এটি ইসলামী জীবনব্যবস্থা অনুমোদিত কোন উৎসব।
ইসলামী আক্বীদাহ অনুযায়ী মঙ্গল-অমঙ্গল করার ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহ’র: রাসুল(সা) বলেছেন: “এ পৃথিবীর সমস্ত জাতি যদি একত্রিত হয়ে তোমাদের মঙ্গল করতে চায়, তবে তারা ততটুকু করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আবার, সমস্ত জাতি একত্রিত হয়ে যদি তোমাদের অমঙ্গল করতে চায় তবে ততটুকুই পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন….।” (তিরমিজী) তাই পহেলা বৈশাখের দিন যেভাবে ঢাকার রাজথে ময়ূর, হাঁস, পেঁচা, রাক্ষস, খোক্ষস কিংবা জীবজন্তুর মূর্তি নিয়ে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, কিংবা নতুন বছরের শুভসূচনা করতে প্রকৃতিপূজারীদের অনুকরণে সূর্যবন্দনা করা হয়, তা ইসলামের দৃষ্টিতে একেবারেই নিষিদ্ধ। কারণ, এইসকল নিষ্প্রাণ মূর্তি কিংবা সূর্যের অকল্যাণ দূর করার যেমন কোন ক্ষমতা নেই, তেমনি তাদের দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনারও কোন ক্ষমতা নেই। বস্তুত: ইসলামে এ সমস্ত কার্যকলাপ আল্লাহ’র সাথে শিরক করার সমতূল্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে নিষিদ্ধ: বৈশাখী মেলা সম্পর্কে এদেশের এক বিখ্যাত ব্যান্ড শিল্পী গেয়েছিলেন: “মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে/ বাসন্তী রঙ শাড়ী পড়ে ললনারা হেঁটে যায়/ বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই।” বাস্তবিক ভাবেই, বৈশাখী উৎসবে সুন্দরী ললনারা বখাটে ছেলেদের হাত থেকে রেহাই পায় না। কারণ, উৎসবের নামে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগমের মধ্যে এদিন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগে, প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বখাটে আর উচ্ছৃংখল তরুণদের হাতে তরুণীরা অত্যন্ত কদর্য ভাবে লাঞ্চিত হয়। গত কয়েক বছর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পহেলা বৈশাখের দিন সন্ধ্যা নামতে না নামতেই বখাটে তরুণরা দলবেঁধে আগত তরুণীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরিহিত কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে তাদের অত্যন্ত কদর্য ভাবে লাঞ্চিত করে এবং পরবর্তীতে প্রায় বিবস্ত্র সেইসব তরুণীদের সহৃদয়বান কিছু তরুণ নিজেদের শার্ট দিয়ে তাদের আব্রু রক্ষা করে।
বস্তুত: ইসলামের দৃষ্টিতে উৎসবের নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বা নারীদের সুসজ্জিত হয়ে পুরূষদের আকৃষ্ট করা, এসবই যিনার অর্ন্তভূক্ত এবং মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন: “তোমরা যিনার নিকটবর্তী হয়ো না, নিশ্চয়ই এটি অত্যন্ত অশ্লীল ও নিকৃষ্ট কাজ।” (সুরা ইসরা: ৩২) এছাড়া, রাসুল (সা) বলেছেন: “জাহান্নামীদের মধ্যে এমন দুটো দল রয়েছে যাদের আমি দেখিনি… এদের একদল হবে নারীদের। যারা পোষাক পরিধান করা সত্ত্বেও তাদের অর্ধনগ্ন দেখাবে। তারা শরীর দুলিয়ে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তারা বুখতি উটের মতো উঁচু করে খোপা বাঁধবে। এসব নারীর কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি তারা জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং, ৫৩৯৭) সুতরাং, রাসুল (সা) এর হাদিস অনুযায়ী যে সব মুসলিম নারীরা আজ পহেলা বৈশাখের নামে নিজেদের আকর্ষনীয় করে সজ্জিত করে পরপুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তাদের পরিণতি জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই না।
আবার অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন, আমরা ঘরে বসে কোন রকম অশ্লীলতা কিংবা মঙ্গলশোভাযাত্রা বা সূর্যবন্দনার অনুষ্ঠানে না গিয়ে নিজেরা নিজেরা কি ঘরে বসে ইলিশ-পান্তা খেয়ে এ উৎসব পালন করতে পারি? উত্তরে বলবো, আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা, আপনাদের কোটি টাকা দিলেও কি আপনারা ঘরে বসে নিজেরা নিজেরা দূর্গাপূজা বা বড়দিনের উৎসব পালন করবেন? করবেন না, কারণ আপনারা জানেন এগুলো ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস বর্হিভূত উৎসব এবং আমাদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক, যা একা একাও পালন করা যায় না। তাহলে, উপরোক্ত আলোচনার পর যখন এটি প্রমাণ হয়ে গেছে অসাম্প্রদায়িক উৎসবের নামে এ দেশের মুসলিমদের আজ যা গেলানো হচ্ছে তার পুরোটাই মুশরিকদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে সর্ম্পকিত, তাহলে কি করে আমরা নিজেরা নিজেরা শুধু ইলিশ-পান্তা খেয়ে এ উৎসব পালন করতে পারি কিংবা আরেক মুসলিম ভাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে পারি?
শেষের কথা: বস্তুত: এদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল কিছু বুদ্ধিজীবি আর সংস্কৃতিমনা কিছু ব্যক্তিত্ব দেশীয় ঐতিহ্য, বাঙ্গালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি কিংবা কৃষ্টিকালচারের নামে পহেলা বৈশাখকে যতই অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, এ উৎসব অতিমাত্রায় সাম্প্রদায়িক এবং সম্পূর্ণ ভাবে হিন্দু ধর্মভিত্তিক একটি উৎসব, যার সাথে এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস বা সংস্কৃতির কোন সর্ম্পক নেই।
এছাড়া, ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির নামে শেকড় বিচ্ছিন্ন এইসব বুদ্ধিজীবিরা হিন্দুসংস্কৃতিকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইলেও, ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এ জনপদের মানুষের মাঝে হিন্দুসংস্কৃতি নয়, বরং ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গভীর ভাবে প্রোথিত। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে তরুন মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জনপদের কিছু অংশ জয় করলে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলামের সংস্পর্শে আসে। এরপর, মুসলিমরা ৭১৪ থেকে ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র সিন্ধু প্রদেশ, পাঞ্জাবের কিছু অংশ, কাশ্মীর ও গুজরাট জয় করে এ অঞ্চলগুলোকে খিলাফত রাষ্ট্রের নীচে নিয়ে আসে। এছাড়া, দিল্লী সালতানাত (১২০৫ – ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ) এবং মোঘল শাসনের (১৫২৬ – ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) প্রায় ছয়শত বছরের শাসনামলেও ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনের অধীনেই থাকে। ইসলামী শাসনের এ সুদীর্ঘ সময়ে দলিত ও সম্ভ্রান্ত উভয় শ্রেণীর অসংখ্য হিন্দু তাদের চরম বর্ণবাদী ও কুসংকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ত্যাগ করে ইসলামের পতাকা তলে আশ্রয় নেয়। তাই, প্রায় হাজার বছরের মুসলিম শাসনামলে এ জনপদের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি সবই ইসলামী আক্বীদাহকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে। দ্বীন-ই-ইলাহী’র প্রবর্তক সম্রাট আকবরের শাসনামল (১৫৫৬ – ১৬০৫) ছাড়া মুসলিম শাসনের বাকী সময় জুড়ে এ উপমহাদেশে শারীয়াহ আইন প্রবর্তিত থাকায়, ভারতবর্ষে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আধিক্য থাকা সত্ত্বেও তা কখনও এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর সার্বজনীন সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য হিসাবে মর্যাদা লাভ করতে পারেনি।
অথচ, ইতিহাস সম্পর্কে এদেশের আপামর মুসলিম জনতার অজ্ঞতার সুযোগে আজ মূর্তিপ্রেমিক ও বর্ণচোরা কিছু নামধারী মুসলিম বুদ্ধিজীবি মুশরিক সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি হিসাবে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টায় করছে। তারা আসলে, এই সমস্ত উৎসবের উছিলায় পুরো দেশ ও জাতির মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলে, আমাদের মূর্তিপুজারী সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। যেন এদেশের আপামর মুসলিম তাদের আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়ে মুশরিকদের সংস্কৃতিকেই তাদের আপন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বলে মেনে নিয়ে মুশরিক রাষ্ট্র ভারতের কর্তৃত্ব আর সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে আর সেইসাথে, এদেশের মাটিতে ইসলামী শাসন আর কখনো ফিরে না আসে। তাই, সচেতন ও এক আল্লাহ’র অস্তিত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি মুসলিমের উচিত শিরকে পরিপূর্ণ এ উৎসব সর্বোত ভাবে বর্জন করা এবং এ আহবানকে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যদি আমার লেখার সাথে কেউ একমত পোষণ করেন, তাহলে লেখাটি শেয়ার করার অনুরোধ রইলো, যেন এদেশের আপামর মুসলিমের কাছে পহেলা বৈশাখের প্রকৃত চেহারা উম্মোচিত হয়।
লেখাটি সংকলিত এবং খুব ই ভালো তাই লেখাটি পরিবত্রন করার প্রয়োজন হয়নাই।